21 Nov 2024, 03:51 pm

শ্রমিক অসন্তোষ : বড় আর্থিক ক্ষতির মুখে পোশাক শিল্প ; কার্যাদেশ হারানোর আশংকা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক :   গত কয়েকদিন ধরে রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্পে চলছে শ্রমিক অসন্তোষ। শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। বেশ কয়েকটি কারখানায় ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্পাঞ্চলে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। এতে ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। দেখা দিয়েছে কার্যাদেশ হারানোর শঙ্কায়।

এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন পোশাক শিল্পের মালিকরা। শ্রমিক অসন্তোষের ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে চরমভাবে। যথাসময়ে পণ্য শিপমেন্ট নিয়ে বাড়ছে চিন্তা। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে উৎপাদন শেষ করতে না পারলে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এয়ার শিপমেন্ট করতে হবে। এতে খরচ বাড়বে কয়েক গুণ। চলমান অস্থিরতা দমন করতে না পারলে ক্রেতাদের আস্থা ধরে রাখা কঠিন হবে।

এছাড়া প্রভাব পড়বে আগামী সিজনের কার্যাদেশে। প্রয়োজন অনুযায়ী কার্যাদেশ না পেলে শ্রমিকের বেকার হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে। কারণ পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না থাকলে কারখানা চালু রাখা কঠিন। শ্রমিক আন্দলনের কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে শিল্পখাত।

সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন,  এটা কোনো শ্রমিক আন্দোলন নয়। আমরা ইউনিয়ন করি, দাবি-দাওয়া পেশ করি এবং আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো আদায় করি। যে সব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা যৌক্তিক নয়।

শ্রমিক অসন্তোষসহ নানা কারণে গত এক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক শিল্প-কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে দুই শতাধিক কারখানায় উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। ফলে শিল্পের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এমসিসিআই)।

শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও অসন্তোষ কমেনি, বরং বিভিন্ন ধরনের অযৌক্তিক দাবি তুলে কারখানা ভাঙচুর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মালিকরা।

প্রথমে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নামেন শ্রমিকরা। পরে তারা চাকরির ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতার দাবি জানান। পাশাপাশি তারা বেকারদের জন্য চাকরি ও কর্মচ্যুতদের চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি তোলেন।

শ্রমিক নেতা ও মালিকপক্ষ তাদের সব দাবি যৌক্তিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তারা মনে করছেন, যে ধরনের দাবি উত্থাপন করা হচ্ছে তা সব পূরণযোগ্য নয়। কোনো ক্ষেত্রে অযৌক্তিকও।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, চলমান শ্রমিক অসন্তোষ থামাতে না পারলে আমরা যথাসময়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারবো না। অন্যদিকে এ অবস্থা চলমান থাকলে বৈশ্বিক ক্রেতারা আমাদের ওপর আস্থা হারাবে। আগামী সিজনের জন্য যে পরিমাণ কার্যাদেশ প্রয়োজন তা পেতে আমরা ব্যর্থ হবো।

চলমান আন্দোলন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সম্মিলিত গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা কোনো শ্রমিক আন্দোলন নয়। আমরা ইউনিয়ন করি, দাবি-দাওয়া পেশ করি এবং আলোচনার মাধ্যমে সেগুলো আদায় করি। যে সব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে তা যৌক্তিক নয়। বেতন বছর শেষে বাড়বে। আর হাজিরা বোনাস ৩০ দিন কাজ করলে পাবে। সেটা বড় কোনো দাবি নয়, এটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান সম্ভব।’

পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, পোশাক শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। ফলে দেশে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। কাজের ধরনের কারণে নারী শ্রমিকরা এ শিল্পের জন্য বেশি উপযোগী। তাছাড়া সমপরিমাণ পুরুষ শ্রমিক পাওয়া যায় না। সুতরাং, এটা যৌক্তিক দাবি নয়।

চাকরি দেওয়া নির্ভর করে চাহিদার ওপর। যখন কোনো কারখানায় শ্রমিকের প্রয়োজন হয় তখন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। শূন্যপদ না থাকলে কাউকে চাওয়া মাত্রই চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। চাকরি দেওয়ার একটি পদ্ধতি রয়েছে। সেটা অবলম্বন করেই শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয় বলে জানান তারা।

মজুরি বৃদ্ধির দাবির প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, নিম্নতম মজুরি বোর্ডের নিয়ম অনুসারে বছর শেষে পাঁচ শতাংশ মজুরি বাড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা শ্রমিকের দক্ষতা ও কাজের ধরনের ওপর নির্ভর করে পাঁচ শতাংশের বেশি বাড়াই। কিন্তু এখন বছরের মাঝখানে এ ধরনের মজুরি বৃদ্ধির দাবি কতটা যৌক্তিক সেটা শ্রমিকদের ভেবে দেখা উচিত।

সর্বশেষ ওয়েজবোর্ডের নিয়ম অনুসারে শিল্প-কারখানার মালিকদের প্রতি বছর পাঁচ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি বাধ্যতামূলক।

বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মাদ হাতেম বলেন, ‘চলমান শ্রমিক অসন্তোষ থামাতে না পারলে আমরা যথাসময়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারবো না। অন্যদিকে এ অবস্থা চলমান থাকলে বৈশ্বিক ক্রেতারা আমাদের ওপর আস্থা হারাবে। ফলে আগামী সিজনের জন্য যে পরিমাণ কার্যাদেশ প্রয়োজন তা পেতে আমরা ব্যর্থ হবো।’

তিনি বলেন, ‘এতে একদিকে যেমন মালিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যদিকে শ্রমিকের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ পর্যাপ্ত কার্যাদেশ না থাকলে আমরা শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পারবো না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখতে হতে পারে।’

সাধারণত শ্রমিকদের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নগুলো নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু চলমান বিক্ষোভের শ্রমিক সংগঠনের নেতারা যুক্ত নন, বরং তারা এটা অযৌক্তিক আন্দোলন বলছেন। মালিক ও শ্রমিক নেতারা এ আন্দোলনের পিছনে আধিপত্য বিস্তার ও ব্যবসা দখলের অপচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।

তাদের দাবি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও এক ধরনের অশ্রমিক স্থানীয় লোকজন শ্রমিকদের উসকে দিয়ে তাদের নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

শ্রমিক নেতা সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ‘বর্তমানে যে ধরনের আন্দোলন চলছে, আমার মতে তা শ্রমিক আন্দোলন নয়। কারণ এই মুহূর্তে শ্রমিকদের তেমন কোনো আন্দোলন দাবি-দাওয়া নেই। যদি কোনো দাবি থাকেও তাহলে সেটা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। বর্তমান অবস্থায় কোনোভাবেই আন্দোলন করা শ্রমিক ও শিল্পের জন্য সমীচীন নয়। অন্য কেউ যেন কোনো ধরনের সুযোগ না নিতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে এর সমাধান করতে হবে।’

শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সিনিয়র সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহিল রাকিব বলেন, ‘এ আন্দোলন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতার লড়াই। এর একটা হলো ঝুটের ব্যবসা দখল, অন্যটি আওয়ামী লীগের শোডাউন দেখানো যে তারা মাঠে আছে। এখানে সাধারণ শ্রমিকদের তেমন কোনো দাবি-দাওয়া নেই। তবে এক জায়গায় বলা হচ্ছে শ্রমিক ছেলে-মেয়ে ফিফটি ফিফটি করতে হবে। আন্দোলনকারীদের একটা অংশ কারখানায় গিয়ে বলছেন ছেলেরা বসে আছে আর মেয়েদের কাজ দিচ্ছেন, এটা হতে পারে না। কিন্তু তারা জানেনই না যে, মেয়েদের হাতের টেইলারিং কাজ পুরুষরা করতে পারবেন না।’

শুধু মালিক নন, শ্রমিক নেতারাও বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্দোলন না করে বরং শিল্পের স্বার্থে কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়েছেন।

শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘পোশাক শিল্প থাকলে চাকরি পাওয়া যাবে। দাবি-দাওয়া আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন। আন্দোলন করে শিল্প ধ্বংস করবেন না দয়া করে। শ্রমিক ভাই-বোনদের অনুরোধ করছি, আপনার কর্মস্থল আপনার একটা পরিবার। আসুন আমরা কারও কথায় কান না দিয়ে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করি এবং কাজে যোগ দেই।’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 3227
  • Total Visits: 1259546
  • Total Visitors: 4
  • Total Countries: 1668

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
  • ৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (হেমন্তকাল)
  • ১৮ই জমাদিউল-আউয়াল, ১৪৪৬ হিজরী
  • এখন সময়, বিকাল ৩:৫১

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
    123
18192021222324
252627282930 
       
15161718192021
293031    
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018